গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের প্রচেষ্টায় শ্রীনিকেতনে গড়ে উঠে 'আবহাওয়া দপ্তর'।

বোলপুর, শান্তিনিকেতন : কৃষিকাজের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত আবহাওয়া বা জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যাদি। তাই গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ‘শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর’। যা দক্ষিণবঙ্গের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৯৩০ সালের ১৫ জুলাই এই আবহাওয়া দপ্তর স্থাপিত হয়। আজ তার ৯৫ বছর পূর্তি হল।
যদিও, উদ্বোধনের দিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। আইনস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য জার্মানি গিয়েছিলেন তিনি৷ আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকেই শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর প্রতিষ্ঠার বীজ বপন হয়েছিল। সেই সময় দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি ছিল খরা প্রবণ ও বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চল৷ তাই আগাম সতর্কতার জন্য শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তরের ভূমিকা আজও অগ্রণী।
প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক কৃষ্ণগোপাল ঘোষ বলেন, “শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বলতে গেলে আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরে ফিরে যেতে হয়৷ কারন প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের আহ্বানে বহুবার গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলিপুরে গিয়েছেন৷ তাঁর থাকার ঘরটি আজ সংগ্রহশালা। শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তরের গুরুত্ব অনেকটাই কারন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাগুলি অতি শীত ও খরা প্রবণ৷ তাই স্থানীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। সতর্ক করা থেকে গবেষণা, দুটি ক্ষেত্রেই শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর উল্লেখযোগ্য।”
শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তরের আধিকারিক সৌমেন্দু বড়ুয়া ও প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক কৃষ্ণগোপাল ঘোষের কাজ থেকে জানা গিয়েছে শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তরের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে গুরুত্বের দিকগুলি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের সম্পর্ক –
প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের পিতামহ গুরুচরণ ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম কাণ্ডারী। এই গুরুচরণের ছোট ছেলে প্রবোধ চন্দ্র ছিলেন বিজ্ঞানী তথা প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের পিতা৷ এই সূত্র ধরে পরবর্তীতে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্রর ঘনিষ্ঠতা নিবিড় হয়৷ ১৯২৩ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের অধিকর্তা ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ। সেই সময় তাঁর স্ত্রী নির্মলা কুমারী দেবী, যিনি ‘রানী মহালনবিশ’ নামে পরিচিত৷ তাঁর আতিথেয়তা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কয়েকবার আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরে গিয়েছেন ও থেকেছেন৷ গুরুদেবকে ‘বর্ষার কবি’ও বলা হয়৷ এই আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরে একাধিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছেন গুরুদেব, সম্মাননাও পেয়েছেন৷ রচনা করেছেন বেশকিছু কবিতা৷ জানা গিয়েছে, এই সময় শান্তিনিকেতনে আবহাওয়া দপ্তর প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল কবিগুরুর৷ পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে এসে বেশকিছু কাল কাজ করেছেন প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ। তিনি এক সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপ্ত সহায়ক ছিলেন।

শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস –
১৮৭৫ সালে ভারতীয় জলবায়ুবিদ্যা বিভাগের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর। তার পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে মেদিনীপুরে ও ১৯৮৫ সালে বাঁকুড়ায় আবহাওয়া দপ্তর গড়ে ওঠে৷ আলিপুরের পর এই রাজ্যে তৃতীয় আবহাওয়া দপ্তর হল শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর। ১৯৩০ সালের ১৫ জুলাই এই দপ্তর প্রতিষ্ঠা হয়৷ আজ তার ৯৫ বছর পূর্তি হল।
উল্লেখ্য, ২২ শে শ্রাবণ কবিপ্রয়াণের দিন শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ হয়। পরের দিন শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ হয়৷ কিন্তু, আগে ১৪ জুলাই, অর্থাৎ আষাঢ় মাসে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব ও ১৫ জুলাই শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব হত৷ এই হলকর্ষণ উৎসবের তাৎপর্য হল, এদিন থেকে পল্লী-গ্রামে চাষ-আবাদের সূচনা হত৷ ১৯৩০ সালে ১৫ জুলাই হলকর্ষণের দিন শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল৷ যদিও, এই সময় শান্তিনিকেতনে ছিলেন না গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই জার্মানিতে গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের। স্বাভাবিকভাবেই পরের দিন আবহাওয়া দপ্তর প্রতিষ্ঠা ও হলকর্ষণ উৎসবে শান্তিনিকেতনে থাকতে পারেননি কবিগুরু৷

কতটা গুরুত্বপূর্ণ শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর?
আবহাওয়া বা জলবায়ুর ভেদ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও দ্বিতীয়টি সাব-হিমালয়ান পশ্চিমবঙ্গ। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গর মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি অত্যন্ত খরা প্রবণ বা অত্যন্ত শীত প্রবণ৷ পাশাপাশি, বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত প্রবণ এলাকা৷ তাই আগাম সতর্কতার জন্য শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তরের গুরুত্ব প্রথম থেকেই অনেক বেশি৷ সাড়ে ২৩ ডিগ্রি কর্কটসংক্রান্তি রেখায় অবস্থিত এই দপ্তর।
এছাড়া, ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতনে পল্লী সংগঠন বিভাগ গড়ে উঠেছিল৷ কৃষি বিজ্ঞানে জোর দিয়েছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কৃষিকাজের সঙ্গে আবহাওয়া বা জলবায়ুর যোগ ওতোপ্রোতো। সেকথা মাথায় রেখেও শ্রীনিকেতনে আবহাওয়া দপ্তর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন কবি ও কবিপুত্র৷ আর এই দপ্তর প্রতিষ্ঠার অন্যতম কাণ্ডারী ছিলেন বিজ্ঞানী তথা গুরুদেবের সেক্রেটারি প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ। আজও দক্ষিণবঙ্গে আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে জলবায়ু নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিষ্ঠান হল শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর। এখানে প্রতিনিয়ত গবেষণা হয়ে থাকে৷
শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তরের আধিকারিক সৌমেন্দু বড়ুয়া বলেন, “আবহাওয়া ও কৃষিবিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক। তাই ১৯২২ সালে যখন শ্রীনিকেতনে পল্লী সংগঠন বিভাগ গড়ে উঠছে, তখন কৃষি গবেষণার জন্য জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য রাখা জরুরি ছিল৷ আর এই শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তর গড়ে ওঠার নেপথ্যে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারন বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা, আত্মীয়তা খুবই গভীর ছিল৷ তাই তাদের প্রচেষ্টায় এই দপ্তর। ছোট নাগপুর মালভূমির পরেই পুরুলিয়া, বীরভূম জেলাগুলি পরছে৷ তাই বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি প্রবণতা অনেক। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকে সতর্ক হওয়ার জন্য ভারতীয় জলবায়ুবিদ্যা বিভাগ শ্রীনিকেতন আবহাওয়া দপ্তরকে গুরুত্ব দিয়েছিল৷ প্রতিষ্ঠার পর অল্প কাজকর্ম হলেও ১৯৬০ সালে এটিকে স্থায়ী কেন্দ্র বা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়।”